প্রকাশিত: Fri, Jul 14, 2023 11:29 PM
আপডেট: Tue, Jun 24, 2025 2:55 AM

বিএনপিকে হয়তো আরও বেশ কিছুদিন বিরোধী দলের ভূমিকাই থাকতে হবে

আরশাদ মাহমুদ, ফেসবুক থেকে: গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো এবং দুটো বড় রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি- যে হারে নাচানাচি শুরু করেছে তা দেখে আমার মনে হল যে, উজরা যেয়া হয়তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা তার সমকক্ষ কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এবং তার সফরকালে তিনি শেখ হাসিনাকে সরিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাবেন এরকম একটা ধারণা অনেকের মধ্যেই ছিল। সেটা না হলেও নিদেন পক্ষে তিনি হয়তো শেখ হাসিনাকে ধমক দিয়ে কিছু কথা বলবেন।

যাহোক সফরের শেষ দিনে আমেরিকান দূতাবাস এবং উজরা একটা বক্তব্য দিয়েছে সেটার সার কথা হল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠ্য নির্বাচন এবং বড় দুই দলের মধ্যে সংলাপ দেখতে চায়। এছাড়াও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উত্তরোত্তর আরো জোরদার হবে এই আশা করে।

তার এই বক্তব্যে আমি তো এমন কিছু দেখলাম না যেটা নিয়ে মাতামাতি করার কোন কারণ আছে। অন্য কথায় বলতে গেলে তিনি অনেকটা ফরমাল, সাদামাটা বক্তব্য দিয়েছেন এবং এটা অনেককেই বিশেষ করে বিএনপিকে খুব হতাশ করেছে।

সত্যি কথা বলতে কি বিএনপি এবং সুশীল সমাজের অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন যে উজরা বলবে আমরা এখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সেটা করবো। এবং দরকার হলে শক্তি প্রয়োগ করবো। 

না এ কথা তিনি বলেননি বা এটা কখনোই কোন সফররত কূটনীতিক বা উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বলবেন না। এটাই নিয়ম।

তবে এ সফরকে ঘিরে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম বা বিভিন্ন জায়গায় যে ধরনের মাতামাতি দেখলাম তখন আমার মনে হল দেখি উজরা যেয়াকে নিয়ে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম কোন কিছু প্রকাশ করলো কিনা।

না, সেরকম কোনো কিছুই বলা হয়নি বা একটি লাইনও লেখা হয়নি। তার কারণ আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমের কাছে এটা কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর না। 

যে কোন দেশের সরকারি কর্মকর্তা বা মন্ত্রীরা বিভিন্ন দেশে যান দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে বা আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে আলাপ করতে। এটা  একটা রুটিন ব্যাপার এবং এটার কোন নিউজ ভ্যালু নেই। সংবাদ মাধ্যমের দায়িত্ব হল যে এটা তার দেশের বা জনগণের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার উপর নির্ভর করে সংবাদ প্রকাশ করা।

সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোর এই নাচানাচি প্রাসঙ্গিক। কারণ বাংলাদেশে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সবার কাম্য এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে সেটা কখনোই সম্ভব হবে না এটা আওয়ামী সমর্থক ছাড়া সবাই জানে।

এটা জানার জন্য আমার ইতিহাস পড়ার কোন প্রয়োজন নেই। আমি এটা গত ৫০ বছর থেকেই দেখছি যে কোন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান কেউ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে যাননি। 

আমরা মোটামুটি সবাই জানি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রধান কারণ হলো জীবিত অবস্থায় ক্ষমতা থেকে সরে গেলে তাকে অনিবার্যভাবে জেলে যেতে হয়। এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং হাসিনা সবাই এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার আরেকটি  পরিণতি হয় ভয়াবহ। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এবং জেনারেল জিয়া এর উদাহরণ। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।

তবে আমার কাছে যে জিনিসটি খুব অবাক লেগেছে সেটা হলো আমাদের সাংবাদিকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি উজরা যেয়াকে করেননি। 

আমি সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকলে একটি মাত্র প্রশ্ন করতাম। সেটি হল শেখ হাসিনা গত কয়েক মাস থেকে পাবলিকলি আমেরিকার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। এমনকি তিনি বিবিসিকে পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে আমেরিকা তাকে পছন্দ করে না এবং তাকে সরাতে চায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আপনার মন্তব্য শুনতে চাই।

কিন্তু আমাদের দেশের সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকদের মান যে পর্যায়ে নেমেছে তাদের থেকে এটা আশা করা বাতুলতা মাত্র। 

এ কথা কে না জানে যে বেশ কয়েক বছর থেকে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এটা মূলত শুরু হয়েছে র‌্যাব এর উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া থেকে। 

এর সুযোগ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বেশ কয়েক বছর থেকে লবিস্ট নিয়োগ করে আমেরিকার প্রশাসনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এটা কোন গোপন তথ্য নয়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও একই কাজ করছে। এই দুই দলের কার কি লাভ হচ্ছে জানি না তবে আমেরিকার লবিস্টদের লাভ হচ্ছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা লক্ষ লক্ষ ডলার আয় করে নিচ্ছে।

এবার মোদ্দা কথায় আসি। ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় রেখে বাংলাদেশে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। সুতরাং বিএনপি যে এক দফা দিয়েছে সেটা বাস্তবসম্মত।

তবে আমার ধারণা বিএনপির এক দফা আল্টিমেটলি কোন কাজে লাগবে না। এবং আপনারা কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাবেন বিএনপির লম্ফঝম্প এবং বক্তৃতাবাজি শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এর বাইরে তেমন  কিছু তারা করতে পারবে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। 

কারণ যদিও শেখ হাসিনার জনসমর্থন এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়, তবুও বিএনপি এটাকে ক্যাপিটালাইজ করতে পারবে না। 

শেখ হাসিনাকে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে বিএনপিকে ব্যাপক জনবিক্ষোভ করতে হবে যাতে তারা সমস্ত দেশকে অচল করে দিতে পারে। কিন্তু সেটা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। গত ১৪ বছর থেকে আমরা দেখছি বিএনপি শুধুমাত্র আল্টিমেটাম দেওয়া ছাড়া এমন কোন গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি যেটাতে শেখ হাসিনা বা ক্ষমতাসীন দল আতঙ্কগ্রস্ত হয়।

বিএনপি’র এই ব্যর্থতার কারণ হলো জনগণ তাদের কথায় আর রাস্তায় নামবে না। তারা তিনবার ক্ষমতায় ছিল এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের দুর্নীতি, অপশাসন এবং অরাজকতা বাংলাদেশের মানুষ এখনো ভুলে যায়নি। 

আর একটি কথা দিয়ে শেষ করি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হলো ইন্ডিয়া। এবং ইন্ডিয়ার নেতা এবং নীতি নির্ধারকরা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে তারা আওয়ামী লীগকে বন্ধু মনে করেন। এ কথা কে না জানে যে তাদের স্বার্থেই ভারত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চান এবং তারা বিএনপিকে একদমই বিশ্বাস করেন না। কারণ তাদের বদ্ধমূল ধারণা বিএনপি পাকিস্তানপন্থী।

এ প্রসঙ্গে আমাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক কি বলেছিলেন সেটা আপনাদেরকে বলি: বি রিষষ হবাবৎ ধষষড়ি ধহু ধহঃর-ওহফরধহ মড়াবৎহসবহঃ ঃড় পড়সব ঃড় ঢ়ড়বিৎ রহ ইধহমষধফবংয. বি রিষষ সধশব ংঁৎব রঃ ফড়বংহ’ঃ যধঢ়ঢ়বহ ধমধরহ. তার এই মন্তব্যের পরে সাউথ এশিয়ান জার্নাল নামে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় আমি দীর্ঘ একটা লেখা লেখি।

কয়েক বছর আগে খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ একজন বিএনপি নেতাকে আমি বলেছিলাম যে আপনারা ইন্ডিয়ার সঙ্গে সমঝোতা না করতে পারলে ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। সে নিজেও সেটা স্বীকার করেছিল।

অবস্থা দৃষ্টি মনে হচ্ছে বিএনপি সেটা করতে পারেনি। ফলে তাদেরকে হয়তো আরও বেশ কিছুদিন বিরোধী দলের ভূমিকাই থাকতে হবে।